ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদ
ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদ, ছোট বেলা থেকেই খুব গাছপালা ভালবাসতেন। কিন্তু তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় উদ্ভিদবিদ্যাকে পাঠ্যবিষয় হিসেবে বেছে নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন ড. ফ্লোরা। মাত্র দেড় বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত এই কৃতি ছাত্রী বুঝতে পারছিলেন না, ফিল্ডওয়ার্ক নির্ভর এই বিষয়ে পড়াশোনাটা তিনি শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারবেন কিনা। উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করা মানেই হলো – নানা জায়গা থেকে নানা ধরনের গাছপালা সংগ্রহ করা অথবা গাছ পালা দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। অভয় দিলেন তাঁর মা ‘তোর বোটানিতে এত আগ্রহ তুই বোটানিতেই ভর্তি হ্; গাছপালা, লতাপাতা যা যা সংগ্রহ করার আমিই করে দেব’। ফ্লোরা সাহস পেলেন, ভর্তি হয়ে গেলেন বোটানিতে। মা তাঁর জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নিয়ে আসেন মাশরুম, বিভিন্ন রোগাক্রান্ত গাছ। একবার করাচি থেকে নিয়ে এলেন সামুদ্রিক শ্যাওলা। মায়ের কালেকশন দিয়েই সর্বোচ্চ মার্কস পেয়ে গেলেন ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদ।
মা নাজমান্নেছা মাজিদ যদি তাঁর পোলিও আক্রান্ত মেয়ের জন্য এই ত্যাগটুকু স্বীকার না করতেন, তাহলে ফ্লোরা হয়তোবা আজকের কৃতী বিজ্ঞানী ড.এফ জেড মাজিদ নাও হতে পারতেন। বাংলাদেশে হয়তো তৈরি হতো না প্রকৃতির এক বিস্ময়কর খাদ্য ‘স্পিরুলিনা’। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় স্পিরুলিনার সফল চাষে নেতৃত্ব দিয়ে ড. ফ্লোরা হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক বিজ্ঞানী। গবেষণা কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ চার চারবার স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছেন। দেশের অন্যতম প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে’র চেয়ারম্যানের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এই পদে সব সময় বাইরে থেকে চুক্তিভিত্তিক চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হতো। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ড. ফ্লোরা প্রথম বারের মতো ঐ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম এ প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে আসীন হয়েছেন। শৈশবে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর ডান পা দুর্বল হয়ে পড়ে, তিনবার দুর্ঘটনায় পতিত হন। সর্বশেষ ১৯৮৯ সালের দুর্ঘটনার পর দুটি ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। এই অবস্থাতেও তিনি দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে বিদেশে গেছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞানী হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন বলেই ১৯৯৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সফলতার সাথে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি হিসেবে চাকরির মেয়াদ ছয় মাস বাড়িয়ে তাঁকে চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদ ১৯৩৯ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোল্লা আব্দুল মাজিদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচেলর স্নাতক। মাতা বেগম নাজমান্নেছা মাজিদ ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী। তিনি সমাজসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ পদক পান। ১৯৫০ এর দাঙ্গার সময় প্রাণভয়ে ভীত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে তিনি আশ্রয় দেন। অনুরূপভাবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের দুস্থ ও অসহায় নরনারীকে তিনি আশ্রয় দেন। ১৯৫৪ সালে ময়মনসিংহের প্রথম প্রসূতি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ঢাকা মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ফকিরাপুল বস্তির গরীব ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং (সেলাই, তাঁতের কাজ, ঝিনুকের কাজ প্রভৃতি)-এর ব্যবস্থা করেন। ছেলে মেয়েদের সাংস্কৃতিক কাজে তিনি সাহায্য সহযোগিতা করেছেন নানাভাবে।
ফ্লোরার দাদা মোল্লা সাদাত্ আলী নরসিংদীর আশরাফপুর গ্রামে অনেক জমি-জমার মালিক ছিলেন। নানা খান বাহাদুর দলিল উদ্দীন আহমদ ম্যাজিস্ট্রেট হলেও তাঁর লেখা ইংরেজি গ্রামার ও ট্রান্সলেশন বই প্রকাশিত হয়েছিল। নানী ফায়জুন্নেসা সমাজসেবী ছিলেন। কঠোর পর্দার অন্তরালে থেকেও তিনি গরীব-দুখীদের সাহায্য করতেন। গ্রামের অনেক ছেলে তাঁর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় তিনি উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করেছেন।
সাত ভাই বোনের মধ্যে ফ্লোরার স্থান চতুর্থ। বড় বোন রুবি রহমান কূটনীতিক স্বামীর সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সম্ভবত তিনিই প্রথম বাঙালি নারী শিল্পী যিনি চীনা পদ্ধতিতে জল রঙে ছবি এঁকেছেন। তাঁর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন চীনের নিসর্গ ও প্রাকৃতিক সুষমা যা মুগ্ধ করেছে কামরুল হাসান ও মুস্তাফা মনোয়ারের মতো প্রথিতযশা শিল্পীদের। তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন সুফিয়া কামাল। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে দামাস্কাস-বৈরুতের পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ঢাকায় জন্ম হলেও ফ্লোরা মাজিদের শৈশব কেটেছে কলকাতা শহরে। বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে চাকরির সুবাদে তাঁর পিতা সেখানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে ফ্লোরা কলকাতার St. John’s Dioscesan Girls’ High School (Dio) – K.G. II তে ভর্তি হন। আসলে ১৯৪৪ সালে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার সময়ই স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেড় বছর বয়সে পোলিও হওয়ায় ফ্লোরাকে ডান পায়ে লম্বা ব্রেস পরতে হতো। এ অবস্থায় মেয়ের অসুবিধার কথা ভেবে এবং ক্লাসে সহপাঠী ছোট ছেলে মেয়েরা নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে এই আশঙ্কা করে মা নাজমান্নেসা তাঁর স্কুল জীবন এক বছর পিছিয়ে দিলেন। এই বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর দেশ ভাগ হওয়ার কারণে তিনি ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকার ইডেন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময় ‘ইডেন স্কুল’ ও ‘কামরুন্নেসা স্কুল’ একত্রিত করে টিকাটুলিতে ‘কামরুন্নেসা স্কুল’ নাম দেওয়া হলো। ঐ একই সময়ে ‘ইডেন কলেজ’ ও ‘কামরুন্নেসা কলেজ’কে একত্রিত করে বকশীবাজারে ‘ইডেন কলেজ’ স্থানান্তরিত করা হলো। ১৯৬০ এর প্রথম দিকে বকশীবাজার থেকে ডিগ্রি সেকশনটিকে আজিমপুরে নতুন ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। ইন্টারমিডিয়েট সেকশনটি বকশীবাজারেই থেকে যায়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বকশীবাজারের কলেজটিকে বদরুন্নেসা কলেজে রূপান্তরিত করা হয় এবং আজিমপুরের ডিগ্রি কলেজকে ইডেন কলেজ নাম দেয়া হয়। কামরুন্নেছা স্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ফ্লোরা প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশ করে ফ্লোরা বকশীবাজারে অবস্থিত ইডেন কলেজে আই.এস.সি.-তে ভর্তি হন৷ এখান থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি প্রথম বিভাগে আই.এস.সি. পাশ করেন এবং ১৯৫৭ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক (সম্মান) পাশ করেন ফ্লোরা। পরের বছর অর্থাত্ ১৯৬১ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানে এম.এসসি.তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি মাত্র দু’বছরে উদ্ভিদ বিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
ড. ফ্লোরা মাজিদের কর্মজীবন শুরু হয় এম.এসসি. পাশ করার আগেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রির তাত্ত্বিক পরীক্ষা দেয়ার পর তাঁর সহপাঠীরা যখন ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন একদিন ঢাকার তত্কালীন ‘কায়েদে আযম বেসরকারি কলেজের’ অধ্যক্ষ জনাব ফাতমী টেলিফোনে ফ্লোরার শিক্ষক এম এ ওয়াদুদকে জানান যে উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক ছাড়াই আই.এসসি. ও বি.এসসি.-র ক্লাস চলছে; এম এ ওয়াদুদ তখন ফ্লোরাকে বলেন, ‘কলেজে যোগদান কর, ভবিষ্যতে এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।’। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই শিক্ষকতা শুরু করেন। এম এ ওয়াদুদ আরো বলেন, ‘কলেজে ছাত্র সংখ্যাই বেশি আর ছাত্রদের অভ্যাস আছে শিক্ষকদের জব্দ করার। দেড়শ জন আই.এসসি.-র ছাত্র যখন এক সঙ্গে জুতা পরা পা মেঝেতে ঘষতে থাকবে তখন শিক্ষকের বক্তৃতা শোনা যাবে না। ক্লাসে মাইকের ব্যবস্থাও নেই।’
তাঁর সতর্ক বাণী ফ্লোরাকে সাহায্য করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছাত্রদের কোনো গোলমালের আভাস পেলেই তিনি ‘সারপ্রাইজ টেস্” নেয়া শুরু করতেন। প্রথম দিকে কিছু ছাত্রছাত্রী ছিল যারা নীরবে লেখা শুরু করতো। পরে অন্যরাও এই বিষয়টিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবেই তিনি এ সমস্যার সমাধান করেছেন।
কায়েদে আযম কলেজ থেকে ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে তিনি ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ করেন। ১৯৬১ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট সাত মাস তিনি কলেজটিতে শিক্ষকতা করেন। এরপর ইডেন সরকারি কলেজে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। কায়েদে আযম কলেজের দেড়শত ডানপিটে ছেলেকে পড়াবার পর ইডেন সরকারি কলেজে যখন তাঁর চাকরি হলো, তখন মনে হলো এর চেয়ে আরামের আর কী হতে পারে। কায়েদে আযম কলেজের ‘সারপ্রাইজ টেস্ট’-এর সুফল দেখে তিনি ঐ পদ্ধতি ইডেনেও অব্যাহত রাখেন। ফলে প্রথম বছরেই (১৯৬২-৬৩) কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা পরীক্ষার ফল খুবই ভালো হয়েছিল, যা তাঁকে যথেষ্ট সুনাম এনে দেয়। ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সহজ ও মধুর।
এক বছর আট মাস শিক্ষকতা করার পর ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে ডক্টরেট করার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ল্যানসিং-এ যান। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডক্টরেট অর্জন করে দেশে ফিরে পুনরায় তিনি ইডেন কলেজে যোগ দেন। ডক্টরেট ডিগ্রী থাকায় তিনি প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু সেখানে গবেষণা করার সুযোগ একেবারেই ছিল না বলে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৬ সালের ২৫ মার্চ থেকে তিনি তত্কালীন পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (পি সি এস আই আর, বর্তমান বি সি এস আই আর)-এর পূর্বাঞ্চলিক গবেষণাগারে উর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন। এখানে তিনি ১৯৭৭ সালে প্রধান বৈজ্ঞানিক পদে এবং ১৯৮৬ সালে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান। অতঃপর ১৯৯১ সালে তিনি সদস্য (উন্নয়ন) পদে পদোন্নতি পান। এই পদে কর্মরত থাকার সময় অক্টোবর ১৯৯৫ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯৬ পর্যন্ত চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্ব পালন করেন। বি সি এস আই আর-এর বিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে তিনিই প্রথম চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হন এবং ঐ বছরের জুন মাস পর্যন্ত এই পদে কর্মরত ছিলেন। তিনিই একমাত্র মহিলা যিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদ অলঙ্কৃত করেন।
দীর্ঘ কর্মজীবনে দুই বছর আট মাস শিক্ষকতা এবং সাড়ে ত্রিশ বছর গবেষণা করেন ড. ফ্লোরা। পি সি এস আই আর-এর উদ্ভিদবিদ্যা শাখার প্রধান ড. হেদায়েতুল্লাহ অবসর গ্রহণ করায় তিনি ঐ শাখার প্রধান হিসেবে কাজে যোগদান করেন। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরাতে খুদা তখন ছিলেন পি সি এস আই আর-এর পূর্বাঞ্চলিক গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। গবেষণাগারটি ‘কুদরাতে খুদা গবেষণাগার’ নামে অনেকের কাছে পরিচিত ছিল। প্রথমেই তিনি ফ্লোরাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, “প্রথম ছয় মাস শুধু পড়াশুনা করো, তারপর কাজ শুরু করো।” তাঁর সে অমূল্য উপদেশ ফ্লোরা পালন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর জন্য পরিতাপের বিষয় হলো পূর্বাঞ্চলিক গবেষণাগারে যোগদানের এক মাস পরেই ড. কুদরাতে খুদা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ফলে তাঁর মূল্যবান পরামর্শ ও নির্দেশ থেকে ড. মাজিদ বঞ্চিত হয়েছিলেন।
তাঁর গবেষণাগারে তখন কাজ চলছিল প্রধানত তিনটি বিষয় নিয়ে। কলাগাছ ও আনারস পাতা থেকে আঁশ তৈরি, ক্লোরেলা (microscopic green alga) এবং বিষাক্ত অণুজীব (microbe) থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতি। এ কাজগুলো অব্যাহত রেখে তিনি মাশরুম শ্রেণীকরণের উপর গবেষণা শুরু করেন। এর আগে এ দেশে মাশরুমের উপর কোনো প্রতিবেদন ছিল না। তাঁদের প্রচেষ্টায় পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ থেকে প্রথমবারের মতো মাশরুম শ্রেণীকরণের উপর তথ্য প্রকাশিত হয়; কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তখন কলাগাছ ও আনারস পাতার পাশাপাশি সুপারি পাতার বাকল থেকে আঁশ তৈরির উপরও কাজ শুরু হয়। এছাড়াও বিভিন্ন তৈলবীজ যেমন সয়াবীন, সূর্যমুখী (sunflower), কুসুম (safflower ) ও ভেরেণ্ডা (castor)-র উপর গবেষণা শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি International Foundation for Science (IFS) থেকে গবেষণা অনুদান পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এটাই ছিল বাংলাদেশে প্রথম আই এফ এস অনুদান। ঐ অনুদানের অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করে গবেষণাগার গড়ে তোলা সম্ভবপর হয়েছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্যাওলা (algae) সংগ্রহ করে তার উপর গবেষণা করা হয়। আই এফ এস-এর সৌজন্যে ড. ফ্লোরা মাজিদ ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন গবেষণাগার পরিদর্শনের সুযোগ পান। এ সময় শ্যাওলার উপর কাজের পাশাপাশি তিনি জলজ উদ্ভিদের উপর কাজ শুরু করেন। জলজ উদ্ভিদকে ধবংস করা সম্ভব নয় বলে ভারত, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে একে কাজে লাগিয়ে জৈব সার তৈরি করা হয়। এ থেকে আরো তৈরি করা হয় গবাদিপশু, হাঁস, মুরগি এবং মাছের খাবার। এগুলি ছাড়াও পানি বিশুদ্ধকরণের কাজেও জলজ উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়। আই এফ এস-এর অনুদানের টাকা দিয়ে তিনি জলজ উদ্ভিদের উপর কাজ করেন।
বাংলাদেশে স্পিরুলিনা চাষের গবেষণায় প্রাথমিক পর্যায়ে ফরাসী সরকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ফরাসী স্পিরুলিনা বিশেষজ্ঞ জর্জ বোনা বি সি এস আই আর – এর একদল বিজ্ঞানীকে এর চাষ পদ্ধতির উপর প্রশিক্ষণ দেন। কিন্তু এক পর্যায়ে মৌসুমী আবহাওয়ার কারণে তিনি বাণিজ্যিকভাবে স্পিরুলিনা চাষে সমস্যার সম্মুখীন হন। নিরাশ হয়ে তিনি দেশ ত্যাগ করলেও ড. মাজিদের নেতৃত্বাধীন আটজন বিজ্ঞানীর দলটি আরো চার পাঁচ বছর গবেষণা করে ঐ সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ হন। বর্তমানে চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বি সি এস আই আর-এর কারিগরী সহায়তা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে স্পিরুলিনা চাষ ও বাজারজাত করছে; যেখানে থাইল্যান্ড ও আমেরিকায় বছরে সাত মাস ধরে স্পিরুলিনা উত্পাদিত হয় বাংলাদেশে তা সারা বছর ধরে উত্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে। স্পিরুলিনা এ শতকের ‘সেরা খাদ্য’ হিসেবে বিবেচিত হয়। উচ্চমান সম্পন্ন প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন বি ১২, লৌহ ও খনিজ উপাদানে পূর্ণ এ খাবারটি নিয়মিত গ্রহণ করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা, রাতকানা, জন্ডিস ও হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে আসে এবং দুর্বলতা ও ক্লান্তি দূর হওয়ায় শরীর সতেজ ও কর্মক্ষম হয়। অনেক ওষুধের দোকানে এটি পাওয়া যায়।
১৯৯৭ সালের জুন মাসে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পরও তিনি গবেষণা কর্ম অব্যাহত রেখেছেন। ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদ গবেষণার পাশাপাশি অনেক বইও লিখেছেন। তাঁর বইয়ের ভান্ডার অনেক সম্মৃদ্ধ।
স্পিরুলিনা প্রকল্পে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য বাংলাদেশ মহিলা বিজ্ঞানী সমিতি ১৯৯৭ সালে ড. মাজিদকে স্বর্ণপ্রদক প্রদান করেন। জলজ উদ্ভিদকে কৃষি সার ও হাঁস মুরগির খাদ্য হিসেবে উদ্ভাবন করার জন্য বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুবুল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্ট ১৯৮৪ সালে তাঁকে স্বর্ণপ্রদক প্রদান করেন। বাংলাদেশ একাডেমী অব সাইন্স ১৯৮৫ সালে তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করেন। ১৯৮১ সালে সেরা মহিলা বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি বাংলাদেশ মহিলা বিজ্ঞানী সমিতি কর্তৃক স্বণর্ণপদকে ভূষিত করে। ২০০৬ সালে বি সি এস আই আর-এর সুবর্ণ জয়ন্তীতে ‘সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারক পদক’-এ ভূষিত হন।
দেড় বছর বয়সে ফ্লোরা মাজিদ পোলিও রোগে আক্রান্ত হন। বাম পা ঠিক থাকলেও ডান পায়ে শক্তির অভাব ছিল। চলাফেরার জন্য একটি ক্র্যাচ ব্যবহার করেছেন ১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। তার পর থেকে দুটো ক্র্যাচ ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু থেমে থাকেনি এই কর্মবীর নারীর কাজের গতি। শারীরিক অসুস্থতাকে ভয় পেলে তিনি আজকের ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদ হতে পারতেন না। কঠোর পরিশ্রম, সদিচ্ছা, মানসিক দৃঢ়তা থাকলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে কোন বাধাই নয় তার বড় প্রমাণ ড. ফ্লোরা।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদ ১৯৩৯ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
পিতা-মাতা: তাঁর পিতার নাম মোল্লা আব্দুল মাজিদ এবং মাতার নাম বেগম নাজমান্নেছা মাজিদ। সাত ভাই বোনের মধ্যে ফ্লোরার স্থান চতুর্থ।
পড়াশুনা: ১৯৪৫ সালে ফ্লোরা কলকাতারSt. John’s Dioscesan Girls’ High School (Dio) – K.G. II তে ভর্তি হন। আসলে ১৯৪৪ সালে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার সময়ই স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেড় বছর বয়সে পোলিও হওয়ায় ফ্লোরাকে ডান পায়ে লম্বা ব্রেস পরতে হতো। এ অবস্থায় মেয়ের অসুবিধার কথা ভেবে এবং ক্লাসে সহপাঠী ছোট ছেলে মেয়েরা নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে এই আশঙ্কা করে মা নাজমান্নেসা তাঁর স্কুল জীবন এক বছর পিছিয়ে দিলেন। এই বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর দেশ ভাগ হওয়ার কারণে তিনি ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকার ইডেন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কামরুন্নেছা স্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ফ্লোরা প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশ করে ফ্লোরা বকশীবাজারে অবস্থিত ইডেন কলেজে আই.এস.সি.-তে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি প্রথম বিভাগে আই.এস.সি. পাশ করেন এবং ১৯৫৭ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক (সম্মান) পাশ করেন ফ্লোরা। পরের বছর অর্থাত্ ১৯৬১ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানে এম.এসসি.তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি মাত্র দু’বছরে উদ্ভিদ বিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
কর্মজীবন: ড. ফ্লোরা মাজিদের কর্মজীবন শুরু হয় এম.এসসি. পাশ করার আগেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রির তাত্ত্বিক পরীক্ষা দেয়ার পর তাঁর সহপাঠীরা যখন ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন একদিন ঢাকার তত্কালীন ‘কায়েদে আযম বেসরকারি কলেজের’ অধ্যক্ষ জনাব ফাতমী টেলিফোনে ফ্লোরার শিক্ষক এম এ ওয়াদুদকে জানান যে উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক ছাড়াই আই.এস.সি. ও বি.এসসি.-র ক্লাস চলছে। এম এ ওয়াদুদ তখন ফ্লোরাকে বলেন, ‘কলেজে যোগদান কর, ভবিষ্যতে এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর ইডেন সরকারি কলেজে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডক্টরেট অর্জন করে দেশে ফিরে পুনরায় তিনি ইডেন কলেজে যোগ দেন। ডক্টরেট ডিগ্রী থাকায় তিনি প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু সেখানে গবেষণা করার সুযোগ একেবারেই ছিল না বলে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৬ সালের ২৫ মার্চ থেকে তিনি তত্কালীন পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (পি সি এস আই আর, বর্তমান বি সি এস আই আর)- এর পূর্বাঞ্চলিক গবেষণাগারে উর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন। এখানে তিনি ১৯৭৭ সালে প্রধান বৈজ্ঞানিক পদে এবং ১৯৮৬ সালে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান। অতঃপর ১৯৯১ সালে তিনি সদস্য (উন্নয়ন) পদে পদোন্নতি পান। এই পদে কর্মরত থাকার সময় অক্টোবর ১৯৯৫ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯৬ পর্যন্ত চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্ব পালন করেন। বি সি এস আই আর-এর বিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে তিনিই প্রথম চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হন এবং ঐ বছরের জুন মাস পর্যন্ত এই পদে কর্মরত ছিলেন। তিনিই একমাত্র মহিলা যিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদ অলঙ্কৃত করেন; দীর্ঘ কর্মজীবনে দুই বছর আট মাস শিক্ষকতা এবং সাড়ে ত্রিশ বছর গবেষণা করেন ড. ফ্লোরা।
মূল লেখক : ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়
পুনর্লিখন : গুণীজন দল